মেয়েটি বায়না করে ছিল

মেয়েটি বায়না করে ছিল
-শুভঙ্কর অধিকারী

 

 

সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মেয়েটি
এখনও বাল্য সুলভ ভাবটি কাটেনি তার।
জল ফড়িং এর মত মাঝে মাঝে আনন্দে মেতে ওঠে
তার সঙ্গে গোটা বাড়ি যেন সে একাই মাতিয়ে রাখে
পৌষের শেষে যেদিন ওই নদীর চড়ে মেলা বসেছিল
সেই দিন মেয়েটি বায়না করে ছিল মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

শীতের কুয়াশা ঠেলে নিষ্প্রভ সূর্য সেদিন
এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে এগোচ্ছে একটু একটু করে
চারিদিকে যখন নতুন চালের গুড়ির পিঠে
খেতে সবাই ব্যস্ত, ঝোলা খেজুর গুড়ের সাথে
খুশির বার্তা নিয়ে আকাশে উড়ছে রং বেরঙের ঘুড়ি।
মেয়েটি তখন বায়না করে ছিল মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

মহাপুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে মকর স্নান ও সকলের সারা
লাল আভা ঐ পশ্চিমের আকাশে, সূর্য গিয়েছে ঢলে
মেয়েটি রঙিন প্রজাপতির মতন সেজেছিল সেদিন
যেন সদ্য গোলাপ যেন পাপড়ি মেলেছে বাগিচাতে
না কোনো ঔদ্ধত্যের পোষাক ছিল না সেদিন
রঙিন সালোয়ার,চাদর তার গায়, লাল ফিতেয় বাঁধা চুল
কালো কাজল টিপ কপালে, হাতে কাঁচের চুড়ি।
মেয়েটি বায়না করে ছিল মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

সাঁঝের আকাশ এক পা দু পা করে কালো আঁধার পথে
শিশির বিন্দু উঠছে জেগে সবুজ ঘাসের আগায়।
মেয়েটি আপন উচ্ছ্বাসে মা, ঠাকুমার হাত ধরে
মনের বাসনা নিয়ে আলো আঁধারি মেঠো পথটি বেয়ে।
ঐ যে চোখ ধাঁধানো রকমারি আলোর আতশবাজি
ঐ যে বাউলের সুরে দোতারা বেজে উঠলো বুঝি।
দূরে ঐ নদীর চরে ভেসে আসে কিছু উন্মত্ত হায়নার উল্লাস
বাতাসে শীতের স্পর্শ তবু অবাধ্য মনে এগিয়ে চলা।
যে মেয়েটি বায়না করে ছিল মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

দুর্ভেদ্য ভিড়, ঠেলা, গুঁতো,তবু এগিয়ে চলেছে মেলার মাঝে
হরেক মেলার দোকান ঘুরে, পাঁপড়, জিলিপি কিনে
মা, ঠাকুমার হাত ধরে এগোচ্ছিল নাগর দোলায় চড়বে বলে।
হঠাৎ বেখেয়ালে ভিড়ের মাঝে পড়লো ঘূর্ণিপাকে
শত শব্দের কোলাহলে ভিড়ের মাঝে হারালো মা, ঠাকুমাকে।
সজল চোখে ফুঁপিয়ে ওঠে ভয়ে, কানে কারও যাচ্ছে না হাঁক ডাক।
চিল, শকুনে ওৎপেতে যেন ছিল লোড শেডিং এর অপেক্ষায়,
মেয়েটির মুখটি চেপে ধরল একটি কালো হাত
টেনে হিঁচরে নিয়ে গেলো দূরের ঐ নদীর পাড়ে, অন্ধকারে।
সেই মেয়েটিকে, যে বায়না করে ছিল, মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

তার সেই আর্তনাদ পৌঁছায়নি কারোর কানে
হিংস্র সেই পিশাচ গুলো একে একে খুবলে খেল যেন
ছিন্ন ভিন্ন হল সেই গোলাপের পাপড়ি গুলো!
কদর্য পায়ে থেঁতলে গেল সেই রঙিন প্রজাপতি!
টুকরো টুকরো হলো কাঁচের রঙিন চুড়ি!
পাঁপড়, জিলিপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে চতুর্দিকে
রইল পরে বালির চরে রক্তমাখা নিথর দেহের সাথে।
সেই মেয়েটি যে বায়না করে ছিল মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

পরদিন কনকনে মাঘের প্রথম কুয়াশাচ্ছন্ন প্রাতে
মেয়েটি চললো বাঁশের দোলায় চড়ে শ্মশান ঘাটে।
আনন্দ উচ্ছল মুখ তার আজ বিকৃত, পাংশুবর্ণ,
সদা হাস্য ঠোঁট দুটি তার আজ রক্ত জমাট
পাঁপড়,জিলিপির খাবার কথা আর বলবে না।
মেলায় যাবার সে সাধ পূর্ণ হয়েছে মেয়েটির
যে মেয়েটি বায়না করে ছিল মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!

এই ভাবেই কি এক এক করে ফুলের মতো মেয়ে গুলো
ঐ অন্ধকারে নর পিশাচের হাতে শিকার হতে দেখব।
এর পর আমার ঘরের কেউ, নয় তো আপনার কেউ
নাকি প্রতীক্ষা করব ভগবানের সেই অলৌকিক বিচারের!
শেষ সিদ্ধান্ত টা যে আমাকে আপনাকে নিতেই হবে
কঠিন হাতে তাদের একে একে নির্মূল যে করতেই হবে
নইলে আজ রাতেও হয়তো শুনবো কোনও মেয়ের আর্তনাদ!
সেই মেয়েটি, যে বায়না করে ছিল, মেলায় যাবে!
দোলায় চড়বে, পাঁপড়, জিলিপি খাবে!!!!!!

Loading

Leave A Comment